সিলেটের চা বাগান মধুপুরে হাতছানি ৬ হাজার একর জমি চাষের উপযোগী

Spread the love

মধুপুর প্রতিনিধি ঃ দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ক্রমাগত নগরায়নের ফলে ও জনতার শহরমুখিতার কারণে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। এছাড়া সামজিক উন্নয়নের ফলে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে। ফলে চায়ের রপ্তানি হঠাৎ করেই কমে গেছে। তারপরও জাতীয় অর্থনীতিতে চা শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী। জিডিপিতে চা খাতের অবদান ০ দশমিক ৮১ শতাংশ।

সমগ্র বাংলাদেশে চা আবাদির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে ১৭টি জেলা বিশেষ করে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইলের মধুপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলায় মোট ১ লাখ ১ হাজার ৭২ হেক্টর ক্ষুদ্রায়তনের চাষযোগ্য জমি চিহ্নিত করা হয়েছে।

টাঙ্গাইলের মধুপুর গড় ও গারো পাহাড়ের পাদদেশ চায়ের নতুন ঠিকানা হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের দুই দফা সফল গবেষণার পর ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ দল মেলে বিকশিত হতে হচ্ছে। ময়মনসিংহ ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারে দেখা যায়, মুক্তাগাছার জমিদাররা মধুপুর গড়ের চন্ডীমন্ডপ মৌজায় ১৯৪০ সালে দার্জিলিং জাতের চা-বাগান করেন। কলকাতা চা বোর্ড থেকে আসা দুই জন অফিসার চা চাষের সফলতা ও ফ্লেভার দেখে অভিভূত হন। কিন্তু সাতচল্লিশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জমিদাররা দেশত্যাগ করায় মধুপুর গড়ে চা চাষে ভাটা পড়ে। কৃষিবিদ আবেদ হোসেন জানান, মধুপুর গড় ও গারো পাহাড়ের পাদদেশে বহুকাল থেকেই তুলা, কফি ও রাবার হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের মতোই আবহাওয়া, জলবায়ু ও মৃত্তিকার সমাহার এখানে। তাই বাণিজ্যিক বা ক্ষুদ্রকায় খামারে চায়ের আবাদ হাতছানি দিচ্ছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মধুপুর গড়ের বিজয়পুর গ্রামে ব্যক্তি উদ্যোগে কয়েকজন কৃষক চা চাষ করছেন।

চাষি আবুল হাশেম দেড় বছর আগে ৪০ শতাংশ জমিতে এক হাজার চারা রোপন করেন। চারার বর্ধন ও গাছের সতেজতা খুবই সন্তোষজনক। নিজের জমিতে আবাদ থেকে তিনি বুঁঝেছেন, মধুপুর পাহাড়ের লালমাটিতে উন্নত মানের চা উৎ্পাদন সম্ভব। আবুল হাশেমের দেখাদেখি গ্রামের অনেকেই ক্ষুদ্র পরিসরে চা লাগিয়েছেন। সেসব চারার ববাড়ন্তে সবাই খুশি। বছরে বেশ কবার পাতা তোলা যায়। অবশ্য প্রসেসিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় চা পাতা বিক্রি হচ্ছে না। বাগানের সবুজ পাতা বিশেষ কায়দায় শুকিয়ে নিজেরা আগ্রহ ভরে পান করছেন। অন্যকেও সেবনের সুযোগ দিচ্ছেন। বাংলাদেশ চা বোর্ডের একটি সূত্র জানায়, দেশে প্রতি বছর চায়ের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সিলেট, চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড়ের পর চা চাষের মতো উঁচু ভূমি খুঁজছিলেন। এরই অংশ হিসাবে ২০০৪ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডের একটি গবেষক দল মধুপুর গড় ও গারো পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় ১৩ হাজার একরে চা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই করেন।

গবেষকরা মাটি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চা চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জানান। কিন্তু পরে এটি আর আগায়নি। বাংলাদেশ চা বোর্ডের আরেকটি গবেষক দল ২০১৭ সালে ড. শামীম আল মামুনের নেতৃত্বে মধুপুর গড় ও গারো পাহাড়ের পাদদেশে পুনরায় চা চাষ নিয়ে জরিপ ও গবেষণা করেন। ঐ টিম পাহাড়ি চালা ও টিলা যেখানে ঢল বা বৃষ্টির পানি দাঁড়ায় না এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণও সন্তোষজনক সেখানে চা চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলী জানান, একাধিকবার গবেষণা ও পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে। দেশের এই বিশেষ ভৌগোলিক এলাকার বড় অংশে আন্তর্জাতিক মানের চা উত্পাদন সম্ভব। আর সেটি বাস্তবায়ন হলে দেশে চা বিল্পব হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৪০০ একর ব্যাপ্তি নিয়ে ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহ চা প্রকল্প’ নামে পাইলট প্রজেক্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা হয়েছে। এটি পাশ হলেই চা চারা বিতরণ, প্রশিক্ষণ এবং প্রণোদনা দেওয়া হবে। স্থাপন করা হবে প্রক্রিয়াজাত কারখানা।

শোলাকুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী জানান, আর গবেষণা নিয়ে কালক্ষেপণ নয়। আমরা এবার চা বিপ্লব তথা পাহাড়ে সবুজের ঝলক দেখতে চাই। টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণের অতিরিক্ত পরিচালক মাহমুদুল হাসান জানান, শুধু মধুপুর উপজেলায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ৬ হাজার একর চা চাষোপযোগী জমি রয়েছে। প্রচলিত ফল ও ফসল থেকে চা চাষ লাভজনক হবে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশ চা বোর্ড এবং নর্থান বাংলাদেশ প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শামীম আল মামুন সাংবাদিকদের জানান, বাণিজ্যিক এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পর্যায়েই চা চাষের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহ চা প্রকল্প’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন হয়ে একনেকে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু হবে। কিন্তু করোনার কারণে প্রকল্প অনুমোদনে ধীরগতি রয়েছে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের জানান, ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহে চা প্রকল্প’ বাস্তবায়িত হলে দেশে চায়ের বিল্পব হবে। চা তখন বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। বহু লোকের কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন হবে। পাহাড়ি জমির সদ্ব্যবহার হবে। সরকার এটিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন।