মো শরিফুল ইসলাম:
প্রকৃতির দখিণা দুয়ারে বইছে ফাগুনের হাওয়া। কোকিলের কণ্ঠে বসন্তের গান। ফুলে ফুলে ভ্রমরের খেলা। পলাশ আর শিমুলের মেলা বসেছে গাছে গাছে। কৃষ্ণচূড়ার ডালে আগুনলাগা রঙ। সব কিছুই জানান দিচ্ছে আজ পহেলা ফাল্গুন। মাঘের জড়তা ভেঙে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। একই দিনে আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। চারদিক তাই লাল-বাসন্তির খেলা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে উদযাপন করা হয় ভালোবাসা দিবস হিসেবে। আর ইংরেজি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী এতোদিন বসন্তের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা ফাল্গুন ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের পর এবার একই দিনে পড়েছে বসন্ত উৎসব আর ভালোবাসা দিবস।
কবির ভাষায়- ‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথায়- ‘বসন্ত আজ আসলো ধরায়, ফুল ফুটেছে বনে বনে, শীতের হাওয়া পালিয়ে বেড়ায়, ফাল্গুনী মোর মন বনে’। আসলে বসন্ত মানে নতুন প্রাণের কলরব। বসন্তে গাছে গাছে নতুন পাতা আসে। ডালে ডালে কোকিল। রঙিন ফুলে প্রকৃতি সুশোভিত হয়ে ওঠে। এই সময়ে বাতাসে ফুলের রেণু ছড়ায়। প্রকৃতি হয়ে উঠে অপরুপ।
বসন্ত উৎসবটি বাঙালির সব বয়সির হলেও এতে তারুণ্যের প্রভাবই থাকে বেশি। এ দিনটিতে তরুণ-তরুণীরা বাসন্তী রঙের পোশাকে নিজেদের সজ্জিত করে। ফুল বিনিময় ও ব্যবহারের ধুম পড়ে যায়। তবে এ সময়ে এই ধরনের আয়োজন গ্রামাঞ্চলের পরিবর্তে শহরাঞ্চলেই বেশি পরিলক্ষিত হয়।
মৃদু মৃদু বাতাস শীতের রুক্ষতা দূর করে মনকে উদাস করে দিচ্ছে। বছর ঘুরে আবারও ফাল্গুনের দেখা। ষড় ঋতুর বাংলায় বসন্তের রাজত্ব একেবারে প্রকৃত সিদ্ধ। ঋতুরাজ বসন্তের বর্ণনা কোনো রংতুলির আঁচড়ে শেষ হয় না। কোনো কবি-সাহিত্যিক বসন্তের রূপের বর্ণনায় নিজেকে তৃপ্ত করতে পারেন না। তবুও বসন্ত বন্দনায় প্রকৃতিপ্রেমীদের চেষ্টার যেন অন্ত থাকে না। ফাগুনের আগুনে, মন রাঙিয়ে বাঙালি তার দীপ্ত চেতনায় উজ্জীবিত হবে।
বাঙালির ইতিহাস আবেগের। এ আবেগ যেমন মানুষে মানুষে, তেমনি মানুষের সঙ্গে প্রকৃতিরও বটে। দিনক্ষণ গুনে গুনে বসন্ত বরণের অপেক্ষায় থাকে বাঙালি। কালের পরিক্রমায় বসন্ত বরণ আজ বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎসব। আবাল-বৃদ্ধ, তরুণ-তরুণী বসন্ত উন্মাদনায় আজকে মেতে উঠবে। শীতকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়েই বসন্ত বরণে চলবে ধুম আয়োজন। শীত চলে যাবে রিক্ত হস্তে, আর বসন্ত আসবে ফুলের ডালা সাজিয়ে। বাসন্তী ফুলের পরশ আর সৌরভে কেটে যাবে শীতের জরা-জীর্ণতা। ভালোবাসার মানুষরা মন রাঙাবে বাসন্তী রঙেই। শীতের সঙ্গে তুলনা করে চলে বসন্তকালের পিঠা উৎসবও।
সরজমিনে দেখা মিলে কালিহাতী উপজেলার সহদেবপুর ইউনিয়নের পৌজান কালিবাড়ী রাস্তার পাশে মুন্দইল গ্রামের মৃত জতুষ পালের বাড়ির সামনে
পলাশ ফুলে রাঙ্গিয়া আছে পুরো গাছ জুড়ে। হঠাৎ ভ্যানের এক যাত্রী মধ্যবয়সী হিন্দু সম্প্রদায়ের মহিলা গাছের নিচে পড়ে থাকা পলাশ ফুল কুড়িয়ে নেন। ঔমহিলা বলেন পলাশ ফুল ছাড়া সরস্বতী পূজা হয়না। এজন্য ফুল নিয়ে যাচ্ছি।
টাঙ্গাইল সেবা ক্লিনিকের মার্কেটিং অফিসার শেখর গাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার পথে রাস্তা থেকে আরমান নামের এক কৃষকে গাছে উঠিয়ে দিয়ে কিছু ফুল সংগ্রহ করে নেন আগামীকাল তাদের সরস্বতী পূজার জন্য। তিনি আরো বলেন টাঙ্গাইলের বিভিন্ন অঞ্চলে আমার চলাফেরা কিন্তু কোথাও এত বড় পলাশ ফুল গাছের দেখা মিলেনি। এই অল্প কিছু ফুল শহরে ক্রয় করতে কমপক্ষে ৫শ’ত টাকা লাগবে।
সিএনজি চালক জামাল রাস্তায় সিএনজি থামিয়ে কিছু ছবি তুলে নিচ্ছে।
রাস্তার পথচারী বিভিন্ন বয়সের মানুষ পলাশ ফুল দেখে সেলফি তুলে নিচ্ছে।
পলাশ ফুল গাছের ডালে ডালে শালিক এবং লম্বা ঠোঁটের মৌচাটুনি পাখি মধুর খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কলা মোচার মধু কিংবা জবা বা শিমুলের মধু এরা চুষে নেয়। মৌচাটুনির প্রথম দর্শন কালিহাতী উপজেলার সহদেবপুর ইউনিয়নের পৌজান কালিবাড়ী রাস্তার পাশে পলাশ ফুল গাছে। ডাক শুনেই মৌচাটুনির খোঁজ পেলাম। পাতার আড়ালে বসে বসে মধু খাচ্ছে। মৌচাটুনির গলার আওয়াজ বেশ কর্কশ। কর্কশ গলায় আওয়াজ তুলে পাখিটি ফুলে ফুলে ঘুরে মধু খাচ্ছে। সরু লম্বা বাঁকানো ঠোঁটে সহজেই ফুলের কলি থেকে মধু আহরণ করতে পারে। জবা ফুল থেকে কখনও চেরি ফুল কখনও বা সফেদা গাছে উড়াউড়ি করে মৌচাটুনি। পাখিটির ঠোঁট শরীরের তুলনায় অনেকটায় বড়। বাঁকানো ঠোঁটের মধু আহরণের কারণেই বোধহয় এরই নাম মৌচাটুনি। তবে খুব একটা এদের দেখা যায় না। চঞ্চলা এ পাখির ছবি তুলতেও বেশ বেগ পেতে হয়।
পহেলা ফাল্গুন বা বসন্ত উৎসব কেবল উৎসবে মেতে ওঠার সময় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য, বাঙালিসত্তা। সে ঐতিহ্যের ইতিহাসকে ধরে রাখতে পারলেই বসন্ত উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্ম ছড়িয়ে দিতে পারবে বাঙালি চেতনাকে। বসন্ত শুধু অশোক-পলাশ-শিমুলেই উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্ত রঙিন পুষ্পিত রক্তের স্মৃতির উপরও রং ছড়ায়। ১৯৫২ সালের আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বাংলা পঞ্জিকা বর্ষের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম দিনকে বাঙালি পালন করে ‘পহেলা ফাল্গুন-বসন্ত উৎসব’ হিসেবে। বাঙালির নিজস্ব সার্বজনীন প্রাণের এ উৎসব এখন গোটা বাঙালির কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। বাংলায় বসন্ত উৎসব এখন প্রাণের উৎসবে পরিণত হলেও এর শুরুর একটা ঐতিহ্যময় ইতিহাস আছে, যা অনেকের অজানা। মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। তখন অবশ্য ঋতুর নাম এবং উৎসবের ধরনটা এখনকার মতো ছিল না। তখনকার আর এখনকার ফাল্গুনের এই উৎসব একদম ভিন্ন। গ্রামে গ্রামে যে আয়োজন হতো তাতে আতিসাজ্যের কোনো সুযোগ ছিল না। আর এখন, সব আয়োজনে খাবার থেকে বিনোদন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে বড্ড বাড়াবাড়ি রকমের লোকদেখানো। মমতা মাখানো মা খালাদের পিঠা পুলি পরিবেশনা যেখানে গ্রামের সব বয়সী শিশুদের অবাধ নিমন্ত্রণ সেই উৎসব এখন বইয়ের পাতাতেও পাওয়া যাবে না। কালের বিবর্তনে আমরা আধুনিক হয়েছি ঠিকই কিন্তু আমাদের বাঙালি সত্বা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
শীতের খোলসে ঢুকে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গম এখন অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে। মৃদুমন্দা বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধে বসন্ত জানিয়ে দিচ্ছে, সত্যি সত্যি সে ঋতুর রাজা। লাল আর হলুদের বাসন্তী রঙে প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের সাজিয়ে আজ বসন্তের উচ্ছলতা ও উন্মাদনায় ভাসবে বাঙালি। তরুণীরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে প্রকৃতির কোলে নিজেকে সপে দিতে চাইবে। অপরদিকে বসন্তের উদাস হাওয়ায় তরুণেরা নিজেকে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে প্রকৃতির মন কাড়তে চাইবে। বসন্ত যেন মানব মন আর প্রকৃতির রূপ প্রকাশের লীলা-খেলা।