নাজিবুল বাশার:
মধুপুরের আনারসের আঁশ বা ফাইবার এখন পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উপকরণ হিসেবে ব্যাপক ব্যবহৃত হচ্ছে। আনারসের পাতার আঁশে চামড়ার মতো মসৃণতা ও শক্তি থাকে, যা বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। এটি মূলত উদ্ভিদ-ভিত্তিক, তাই এটি প্লাস্টিক ও চামড়ার বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। লাল মাটির আনারস যেমন গুণেমানে অসাধারণ সুসাধু ও ভিটামিন সমৃদ্ধ।
পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ আনারস শুধু ফল হিসেবে নয়, এটির পাতারও ব্যবহার হয় নানান কাজে। অতীতে আনারস তোলার পর পাতা ফেলে রাখা হতো অথবা গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হতো। কিন্তু বর্তমানে এর পাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানান শৌখিন পণ্য-পাইনাটেক্স, পালংকা, গদি ও আসবাবপত্র, ম্যাট, ঝুড়ি, ও দড়ি, বায়োডিগ্রেডেবল প্যাকেজিং, হাতের কাজের সামগ্রী, জৈব সার ইত্যাদি। সেই সাথে মিলছে অর্থকড়িও। ক্রমে এর উৎপাদন এবং ব্যবহারেরও প্রসার ঘটছে। আনারস উৎপাদনে প্রসিদ্ধ টাঙ্গাইলের মধুপুর লাল মাটির গড়। এখানকার নারীরা প্রথমে ব্যক্তি উদ্যোগে ঘর-গৃহস্থালির কাজে লাগে এমন কিছু শৌখিন জিনিসপত্র বানালেও পাতা থেকে সুতা উৎপাদনে হাত দেয় ‘মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি বাংলাদেশ’ নামের একটি বিদেশি সংস্থা। তাও ২০০৮ সালের কথা। এ সংস্থার প্রকল্পটি ছিল উপজেলার জলছত্র বাজারে।
২০১৭ সালে এসে বনাঞ্চলের জাঙ্গালিয়া গ্রামে ব্যুরো বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে একটি হস্তশিল্পের কারখানা। এখানে শতাধিক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আনারস চাষিদের ফেলে দেওয়া পাতারও সদ্গতি হয়েছে। ফলে তারা আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছে। ফাইবার এক্সট্রাকশন মেশিনের মাধ্যমে আনারস পাতা থেকে আঁশ বের করা হয়। তারপর ভাঙা প্লেট ও নারিকেলের খোল দিয়ে ঘষে পাতা থেকে আঁশ বের করে পানিতে ধুয়ে নেওয়া হয়। পরে সেগুলো রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। এক কিলোগ্রাম পাতা থেকে ৬০ সেন্টিমিটার লম্বা শক্ত সুতা পাওয়া যায়। আঁশ বের করার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ৩০ জন মানুষের সাহায্য লাগে। ১ হাজার কেজি পাতা থেকে ১০০-১৫১ কেজি আঁশ পাওয়া যায়। আনারসের পাতার ফাইবার কাগজ ও কার্ডবোর্ড তৈরির জন্য উপযোগী। এটি শক্ত এবং টেকসই হওয়ায় কাগজের বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আনারস পাতার কাগজ কারুশিল্প, খাতা, এবং অন্যান্য কাগজ সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
বিশেষ করে সুতাগুলো হাতে রশি পাকিয়ে হস্তশিল্প ও গৃহসজ্জার নানান রকম জিনিসপত্র বানানো যায়। এ ছাড়া সুতা থেকে উন্নতমানের কাপড়ও তৈরি হয়। আশার বিষয়, আনারস পাতা থেকে উৎপাদিত সুতা দিয়ে উন্নতমানের লেদার বানানোর কাজে এটি দেশের বাইরে রফতানি করা হচ্ছে। আবার যেসব পাতা থেকে সুতা তৈরি করা যায় না, সেগুলো থেকে জুয়েলারি বক্স, টেবিল ম্যাট, ফ্লোর ম্যাট, ফ্লাওয়ার বক্স, ওয়াল হ্যাঙ্গিং, চাবির রিংসহ নানান পণ্য বানানো হয়। আকর্ষণীয় এসব পণ্য যাচ্ছে চীনসহ উন্নত দেশগুলোতে। এখানে কাজ করে অনেক নারীই হয়ে উঠছেন স্বাবলম্বী। আগে যেসব নারী বনে ও আনারসের জমিতে কাজ করে যে টাকা পেতেন, তার চেয়ে বেশি টাকা পাচ্ছেন এ হস্তশিল্পের কাজ করে। ফলে সংসারের অভাব মিটিয়ে তারা এখন অনেকটা সচ্ছল জীবনযাপন করছেন। কথা হয় উপজেলার বেরীবাইদ গ্রামের ফিরোজ মিয়ার সঙ্গে। তিনি এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন।
আনারসের পাতা থেকে এত সুন্দর পণ্য তৈরি হতে পারে তা আগে জানতাম না। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব জানতে পেরেছি। তার মতো আরও অনেক শ্রমিক এখানে কাজ করছেন। তারা আনারস চাষের পাশাপাশি বাড়তি উপার্জন করতে পার্টটাইম কাজ করছেন। আনারস চাষি রাজ্জাক মিয়া বলেন, একটি পরিপূর্ণ আনারস গাছে ৩৫টি পাতা হয়। একটি গাছে একবারই ফল ধরে। ওই গাছের গোড়ায় নতুন গাছ জন্মায়। আনারস কাটার পর ওই গাছের অন্তত ১৬-২১টি পাতা কেটে ফেলা হয়। আর নতুন গাছ হওয়ার পর সব পাতাই কাটা যায়। এই পাতাগুলো নিচে পড়ে নষ্ট হয়। মাটিতেই পচে মিশে যায়। কেউ কেউ গবাদিপশুর জন্যও নিয়ে যান। কিন্তু কয়েক বছর ধরে আমরা বিক্রি করছি। আনারস বেচার টাকার পাশাপাশি বাড়তি টাকা পাচ্ছি পাতা বিক্রি করে। ব্যুরো বাংলাদেশের হস্তশিল্পের কারখানার এজিএম আমীর হামজা বলেন, নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন শৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করা হচ্ছে। এতে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। আগে যারা আনারস বাগানে কাজ করতেন, সেসব নারী আমাদের এখানে কাজ করছেন। এখানে ৭০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে অধিকাংশ নারী। যারা সুবিধাবঞ্চিত নারী, স্বামী পরিত্যক্তা নারী তারাই এখানে বেশি কাজ করেন।
এখানে প্রায় চারশ শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে মজুদ আছে অনেক পণ্য-সে কারণে আমরা উৎপাদন আপাতত কমিয়ে দিয়েছি। তবে আমরা একটি কম্পমেস কারখানা তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছি।’ এ উপজেলায় বিভিন্ন স্থানের বাগানগুলো যদি সরকারের পক্ষে আমাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে তাহলে উৎপাদিত পণ্য গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করা যেত বলে জানান এ কর্মকর্তা। স্থানীয় এক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রশিক্ষণে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগায় তারা তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেন না এ কাজে। এজন্য শ্রমিকদের শিক্ষানবিশকালীন ভাতা বা প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকলে তারা আগ্রহী হয়ে উঠবে এ পেশায়। নারী উদ্যোক্তা ও ব্যুরো ক্রাফটের পরিচালক রাহেলা জাকির বলেন, ‘এ উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস বেশি।
অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এই মানুষদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে মধুপুরে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।’ এ উদ্যোক্তা আরও জানান, চীনের একটি মেলায় তারা অংশগ্রহণ করে এসব পণ্যের বেশ সাড়া পেয়েছেন। এ ছাড়া আরও অনেক দেশই হস্তশিল্পের এ পণ্যের প্রতি আগ্রহের কথা জানিয়েছে। আনারসের কিছু পাতা আছে যেগুলো দিয়ে আঁশ বানানো সম্ভব হয় না, সেগুলো দিয়ে আমরা টিস্যু পেপার তৈরি করছি। আনারসের কোনো কিছুই আর ফেলবার নয়। তাদের ওয়ান টাইম প্লেট ও গ্লাস তৈরির পরিকল্পনা চলছে। পরিত্যক্ত প্রাকৃতিক কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পরিবেশবান্ধব এসব পণ্যের দেশের বাইরে চাহিদা রয়েছে বলে জানান তিনি।
আনারসের আঁশ থেকে তৈরি এই ধরনের পণ্য আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করতে সহায়তা করে এবং টেকসই ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান হিসেবে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই উপকরণগুলো কেবলমাত্র টেকসই অর্থনীতিতে সহায়তা করে না, বরং স্থানীয় জনগণের জন্য নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করে।