যুগধারা ডেস্ক :
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় ৩৪টি নির্দেশনা আছে; কিন্তু সেখানে জনগণ বা সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে আচরণের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। বিশেষ করে সম্বোধনের বিষয়ে কিছু বলা নেই।
সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলা নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে আলোচনায় এসেছে ৪৪ বছর আগে প্রণীত সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯। ২০০২ ও ২০১১ সালে দুই দফায় এই বিধিমালা সংশোধন করা হয়।
২০১৪ সালে আবার এই বিধিমালা সংশোধনের কাজ শুরু হয়। ৯ বছরে বিধিমালার একটা খসড়া তৈরি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে এখনো তা চূড়ান্ত করা হয়নি। এই খসড়ায়ও সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে আচরণ বা সম্বোধনের বিষয়ে কিছু বলা নেই।
বর্তমান বিধিমালায় দেশে বা বিদেশে কারো কাছ থেকে উপহার বা পুরস্কার নেওয়া, যৌতুক দেওয়া-নেওয়া, ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসায় যুক্ত হওয়া, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ততা, ক্ষমতার অপব্যবহার, গণজমায়েত করা, তথ্য প্রকাশে কঠোরতা, নারী সহকর্মীর সঙ্গে আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা আছে। শুধু নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো নির্দেশনা নেই।
অবশ্য ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে, এমনটি লেখা আছে। এই বিধিমালার দুই ধারায় অসদাচরণ বলতে বোঝানো হয়েছে, অসংগত আচরণ, চাকরি-শৃঙ্খলাহানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ। তবে এসবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা সেখানে নেই।
আচরণ বিধিমালার খসড়ায় যা আছে–
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্প্রতি সংশোধিত আচরণবিধির একটি খসড়া তৈরি করেছে। এতে কয়েকটি বিষয়ে বেশ পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে নাগরিকদের সঙ্গে আচরণের বিষয়টি এবারও নেই।
যেমন—খসড়ায় বলা হয়েছে, উপঢৌকন গ্রহণ করতে হলে সরকারের পূর্বানুমতি লাগবে। বর্তমানে কোনো অনুষ্ঠানে সরকারের অনুমোদন ছাড়া ২৫ হাজার টাকা মূল্যের উপহার গ্রহণের রীতি প্রচলিত। এ অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হচ্ছে।
আবার বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা বিদেশি সরকারের কোনো কর্মকর্তার কাছ থেকে পাঁচ হাজারের পরিবর্তে ৪০ হাজার টাকা মূল্যের উপহার গ্রহণ করা যাবে বলে খসড়ায় বলা হয়েছে। স্থাবর সম্পত্তির অধিকারী অথবা ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত কোনো ব্যক্তির কাছে বা কাছ থেকে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি মূল্যের কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়, বিক্রয় বা অন্য কোনো উপায়ে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রধান বা সরকারের সচিবকে অবগত করতেন। এখন খসড়ায় বলা হয়েছে, পাঁচ লাখ টাকা বা তার বেশি হলে বিভাগীয় প্রধান বা সরকারের সচিবকে জানাতে হবে।
সরকারি চাকরিজীবীদের পাঁচ বছর পর বাধ্যতামূলকভাবে সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিধান আছে। খসড়ায় সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি যাচাই-বাছাই করার বিধান রাখা হয়। এ ছাড়া কেউ ভুল তথ্য দিলে আইনগত ব্যবস্থা ও বিভাগীয় মামলা করা যাবে।
সংবিধান, প্রশিক্ষণ ও বাস্তবতা
সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। ’ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আগে যেসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাতে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্তদের বারবার বলা হয়, তাঁরা জনগণের সেবক; কিন্তু চাকরিতে যোগদানের পর বাস্তবতা বদলে যায়।
বাাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আচার-আচরণ, কাকে কীভাবে সম্বোধন করবে, কার সঙ্গে কী আচরণ করবে, কীভাবে খাবে এবং প্রটোকল মেনে চলবে—এসব ফাউন্ডেশন কোর্সে বিস্তারিত শেখানো হয়। এ ছাড়া প্রতিটি প্রশিক্ষণের সময় সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, সংবিধান পড়ানো হয়। এর পরও কেন বারবার এমন ঘটনা ঘটছে, তা নিয়ে গবেষণাও হচ্ছে। গবেষণার ফল ধরে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে তা কার্যকর করা হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও প্রশিক্ষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সহিদউল্যাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ফাউন্ডেশন কোর্স মূলত কর্মকর্তাদের সার্বিক আচার-আচরণ সম্পর্কিত। প্রশিক্ষণের শুরুতে কর্মকর্তাদের ভালোভাবে শেখানো হয়, যে যেখান থেকে আসুক আপনি বলবেন, বসতে দেবেন, হাসিমুখে সম্মান দিয়ে কথা বলবেন। কোনো নাগরিককে কষ্ট দেবেন না। এর পরও মাঠ প্রশাসনে সমস্যা হয়ে যায়। কারণ তিন থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণে কিছু হয় না। এ জন্য রিফ্রেশার কোর্স চালু করতে হবে। এগুলো চালু হলে দু-এক মাস পর পর মনে করে দেওয়া যাবে।
পুরনো আদেশ এবং…
তিন দিন ধরে ১৯৯০ সালে জারি করা তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশ ফেসবুকে ঘুরছে। যেখানে বলা আছে, মৌখিক সম্বোধনে পুরুষের ক্ষেত্রে ‘স্যার’ ও নারীদের ক্ষেত্রে ‘ম্যাডাম’ ব্যবহার করা যেতে পারে; কিন্তু আদেশ কার বেলায়, কোথায়, কীভাবে কার্যকর হবে—এ বিষয়ে কিছু বলা নেই।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষের (বাবাকো) বিশেষজ্ঞ কাজী জুলফিকার আলী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আমার জানা মতে, এ ধরনের কোনো আদেশ নেই। বাবাকোর সব আদেশ নিয়ে ২০১১ সালে একটি ম্যানুয়েল করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই ম্যানুয়েলে এসংক্রান্ত কোনো আদেশ নেই। ’
সম্বোধনসংক্রান্ত কোনো আইন বা বিধি নেই–
গত বছরের এপ্রিলে নেত্রকোনার কালমাকান্দা উপজেলায় ইউএনওকে স্যার না বলায় থানার ওসি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে হেনস্তা করেন। ওই বছরের ৯ জুলাই মানিকগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুনা লায়লাকে ‘ম্যাডাম’ না বলে আপা বলায় ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র দাসকে লাঠিপেটা করে তাঁর সঙ্গে থাকা পুলিশ।
সাধারণ মানুষ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কী বলে ডাকবে এ বিষয়ে ঢাকা, রংপুর, বরিশাল, খুলনা ও সিলেট বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে জবাবে পাঁচ বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, সম্বোধনসংক্রান্ত কোনো আইন বা বিধি বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে নেই।
বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব শেখ ইউসুফ হারুন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, প্রশিক্ষণে সরকারি কর্মকর্তাদের জনগণের সঙ্গে ভদ্র, নম্র ব্যবহার করতে বলা হয়। তাঁদের স্যার বলতে হবে, এটা তো কখনো বলা হয় না। তিনি বলেন, স্যার বলা বা বলতে বাধ্য করানো ঔপনিবেশিক মানসিকতা। সম্মানের বিষয়টি পারস্পরিক; তা জোর করে আদায় করা যায় না। তবে তিনি মনে করেন, সাধারণ মানুষ সরকারি কর্মচারীদের কিভাবে সম্বোধন করবে—এই বিভ্রান্তি দূর করতে সরকারের নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
অসদাচরণের প্রতিকার নেই–
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ না বলায় সেবাগ্রহীতা নাগরিকদের প্রতি অসদাচরণের ঘটনা ঘটছে। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
‘স্যার’ না বলায় রংপুরের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) ক্ষুব্ধ আচরণের শিকার হয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। প্রতিবাদে তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচিও শুরু করেছিলেন। ডিসি চিত্রলেখা নাজনীন দুঃখ প্রকাশ করে ওই ঘটনার ইতি টানান।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মামুন খানকে ফোনে ভাই সম্বোধন করেন এক সাংবাদিক। এসিল্যান্ড তাতে খেপে যান।
২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্বরত একজন চিকিৎসককে ‘স্যার’ না ডেকে দাদা ডাকায় এক স্ট্রোকের রোগীকে চিকিৎসা না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। বছর কয়েক আগে যশোরে একজন কৃষি কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ না বলায় ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি অফিস থেকে চার সাংবাদিককে বের করে দিয়েছিলেন। এসব ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
২০২১ সালের নভেম্বরে একই ধরনের কয়েকটি ঘটনা ঘটার পর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন তখন বলেন, সরকারি সেবা নিতে আসা লোকজনকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করতে হবে, এমন কোনো নীতি নেই। যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা জনসাধারণের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন তবে তা দুর্নীতির শামিল।
জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিদেশে সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের নাম ধরে ডাকে (নাগরিকরা)। এ দেশেও এই সংস্কৃতি শুরু করে সবাইকে নাম ধরে ডাকা উচিত। এটাই আন্তর্জাতিক চর্চা। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তবেই এ সমস্যার সমাধান হবে।
যুগধারা ডট টিভি/অন্তু