স্টাফ রিপোর্টার : ৭ ডিসেম্বর ২০২৪ বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক, টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও নাট্যকার নৃপেণ বিশ্বাসের ২১ তম প্রয়ান দিবস।
এ উপলক্ষে নৃপেণ বিশ্বাস স্মৃতি সংসদ, ভূঞাপুর, ঘাটাইল ও গোপালপুর প্রেসক্লাব এবং তার পরিবার কর্মসূচি গ্রহণ করবে বলে নৃপেন বিশ্বাস স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রাজন বিশ্বাস নিশ্চিত করেছেন। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে স্মরণ সভা, বিশেষ প্রার্থনা, প্রসাদ বিতরণ ও কৃর্তানুষ্ঠান।
গাংচিল ও মুক্তকথা নামে দুটি লিটল ম্যাগাজিন আশির দশকে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলা শহর থেকে প্রকাশিত হতো। বংশাই সাহিত্য সংসদের মুখপত্র ম্যাগাজিন দুটি যিনি সম্পাদনা করতেন তাঁর নাম নৃপেণ বিশ্বাস। সে সময় তিনি বংশাই সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। ২০ বছর আগে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর আজকে এই দিনে লিভার সিরোসিস-এ আক্রান্ত হয়ে ঢাকার গ্যাস্টোলিভার হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরলোকগমন করেন। সাংবাদিকতা, সাহিত্যচর্চা, অভিনয়, নাটক এবং অনুষ্ঠান নির্মাণের মাধ্যমে দেশ, জাঁতি ও সমাজকে তিনি যা দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। তার অম্লান স্মৃতি চির জাগরুক থাকবে- সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সংবাদকর্মীদের মনের মণিকোঠায়।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার নন্দনগাতি গ্রামে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ২ ফেব্রুয়ারি নৃপেণ বিশ্বাস প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেন। এরপর ধীরে ধীরে শৈশব, কৈশোর পাড়ি। নন্দনগাতি গ্রামের সেই শিশুটি হয়ে উঠেছিলেন জাতীয়ভাবে পরিচিত একজন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও অনুষ্ঠান নির্মাতা। যার ডাক নাম মঙ্গল। গ্রামের সবাই তাকে এ নামেই ডাকতো। বাবার নাম গোপাল বিশ্বাস, মা- মালতী বিশ্বাস।
টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক ‘ঝংকার’ পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন নৃপেণ। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে যেটি সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হতো। সে সময় ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকায় ঘাটাইল থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতেন তিনি।ঘাটাইলের সাংবাদিকতা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা ঘটনার সঙ্গে ছিল তার নিবিড় সম্পৃক্ততা।
১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ঘাটাইল প্রেস ক্লাব গঠন হলে এর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন নৃপেণ। এরপর ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। যে কয়েকজন ব্যক্তি সে সময় ঘাটাইলের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন এবং যাদের কারণে সে সময় ঘাটাইলের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল তাদের মধ্যে নৃপেণ ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। সেদিন তারা যে কর্মযজ্ঞ চালিয়েছিলেন তা চমক সৃষ্টি করেছিল ঘাটাইলের সুধীমহলে। তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রেম যুগ যুগ ধরে উদাহরণ হয়ে থাকবে।
ঘাটাইলের সাহিত্য জগতে তারা থাকবেন দৃষ্টান্ত হয়ে।নৃপেণ বিশ্বাসের সহযোদ্ধাদের মধ্যে হায়দার রহমান, আতা খন্দকার, এস আকবর খান ও জিন্নাহ- বিন- জয়েনউদ্দিন এর নাম উল্লেখযোগ্য।
এ প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবে আরেকজন সু-সাহিত্যিকের নাম এসেই যায় তিনি হলেন- কবি মুজাফ্ফর আলী তালুকদার। যিনি ঘাটাইলের সাহিত্যকর্মীদের অভিভাবক এবং নৃপেণ বিশ্বাসের পরম শ্রদ্ধেয়দের মধ্যে অন্যতম।আরো অনেক সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমির সমাবেশ ঘটেছিল বংশাই সাহিত্য সংসদকে কেন্দ্র করে। নৃপেণ বিশ্বাস সে সময় পৌরমুকুল একাডেমি নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। যে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন।
১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে নৃপেণ ঢাকায় গিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। শুরু হয় বৃহত্তর পরিম-লে তার সাংবাদিকতা জীবনের নুতন অধ্যায় তারকালোক ও কিশোর তারকালোকে যোগদানের মধ্যদিয়ে সূচনা হয় তার ঢাকার সাংবাদিকতার জীবন। তাকে বিজ্ঞ সাংবাদিক বানানোর কুশলী ছিলেন ঘাটাইলের আরেক কৃতী সন্তান আরেফিন বাদল।নৃপেণ বিশ্বাস প্যাকেজ প্রোগ্রাম বিষয়ক জাতীয় সাপ্তাহিক ‘সবার জন্য পত্রিকা’ ও পাক্ষিক ‘তারকাবিচিত্রা’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে বেশ কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন।
সাংবাদিকতা জীবনে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে দৈনিক আজকের কাগজের স্টাফ রির্পোটার হিসেবে যোগদান এক বিস্ময় ও চমক ছিল।তিনি ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি বিটিভির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনমূলক অনুষ্ঠান ‘পরিপ্রেক্ষিত’, সৈয়দ বোরহান কবীর পরিচালিত ‘প্রেক্ষাপট’ এবং ‘দ্বিতীয় পাতা’-এর সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন।
তারকালোক পত্রিকার টিভি বিভাগের প্রধান, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও এর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উপর গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টিং করেন। যা পাঠক মহলে প্রশংসা পেয়েছিল। ৯০ এর গণআন্দোলনের তদানিন্তন এরশাদ সরকারের মদদপুষ্ট বিটিভির কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতি রিপোর্ট করে পাঠক মহলে সারা জাগিয়েছিলেন।সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় মনোনিবেশ করেন নৃপেণ।
ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও নাটক রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার লেখা অনেকগুলো বই প্রকাশ হয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উপন্যাস- কিশোরী কিংবা যুবতী (দীব্য প্রকাশনী), ভুল মানুষের ভালোবাসা (শিরিন পাবলিকেসন্স), কিশোর উপন্যাস- বানরখালীর ভুত (সযুতি প্রকাশনী) উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ বেতারে তার লেখা একাধিক নাটক ও নাটিকা প্রচার হয়েছে। বেতারে মহানগর এবং আমাদের দেশ অনুষ্ঠানে তার লেখা প্রতিবেদন ও কথিকা দীর্ঘদিন সম্প্রচারিত হয়েছে।এক সময় সাংবাদিকতা ছেড়ে টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন নৃপেণ বিশ্বাস। নাটকসহ তার নির্মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান বিটিভি, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই ও এনটিভিতে সম্প্রচার হয়েছে। বিটিভিতে প্রচারিত নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিপ্রতিপ সময়, নয়নচারা ও ঘাট।
বিটিভির জন্য তিনি একজন ‘ফেলু মামা’ নামে ৫২ পর্বের ধারাবাহিক নাটক নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে বেশ কয়েকটি পর্বের কাজ শেষও করেছিলেন। এটিএন বাংলায় নিয়মিত কাজ করেছেন নৃপেণ। তার নির্মিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘সুতরাং’ একটি জনপ্রিয় ও সফল অনুষ্ঠান। এর ৮০টি পর্ব প্রচার হয়েছে। এই চ্যানেলে যাত্রী নামের একটি খ- নাটক প্রচার হয়েছে।এছাড়া ‘অজান্তে একদিন’ নামে ১০ পর্বের ধারাবাহিক নাটক ও শিশু-কিশোরদের জন্য নির্মিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘অভিষেক উৎসব’ নির্মাণ করেছিলেন। তার গ্রন্থনা ও পরিচালনায় দূর্গাপুজা উপলক্ষে দীর্ঘ ৪ বছর বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছে।প্রয়াত কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পীকে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান, ফ্যাশন বিষয়ক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ময়ূরী চতুরঙ্গ’ নামে ১০টি পর্ব প্রচার হয়েছে এটিএন বাংলায়।
চ্যানেল আইয়ের জন্য তিনি বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করেন। এরমধ্যে মোজাম্মেল হোসেন মিন্টু রচিত ৫ পর্বের ধারাবাহিক নাটক ‘আকাশের চোখে বৃষ্টি’ নির্মাণ করেছিলেন।তিনি অসুস্থ অবস্থায়ও এনটিভির জন্য দূর্গাপুজা উপলক্ষে বিশেষ আলেখ্যানুষ্ঠান ‘দূর্গা দূর্গাতিনাশিনী’ নির্মাণ করেন। ক্রিয়েটিভ প্লাস প্রযোজিত এ বিশেষ অনুষ্ঠানটি ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর রাত ৯ টায় ও ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর রাত ৯:৩০ টায় প্রচারিত হয়।
তিনি এ চ্যানেলের জন্য র্শিশু-কিশোরদের উপযোগী ‘হইচই’ নামের একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নির্মাণ করেন। তার নির্মিত বিজ্ঞাপন চিত্রও বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচার হয়েছে। তিনি অনেকগুলো কোম্পানির ডকুমেন্ট নির্মাণ করে গেছেন। এরমধ্যে ‘সিনজেনটা’ ও সিনপার’ কোম্পানির ডকুমেন্ট নির্মাণ করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অন্য ডকুমেন্টগুলোর মধ্যে টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্প, পেড়াবাড়ির চমচম, জামালপুরের কাশাশিল্প উল্লেখযোগ্য। ছাত্রজীবনের নৃপেণ বিশ্বাস মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন।
এলাকার অনেক নাটক তার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা এবং সার্বিক তত্ত্ববধানে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছে। তিনি জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ থিয়েটারে একজন অভিনেতা হিসেবে সুধী মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের বেশ কয়েকটি সাপ্তাহিক নাটক ও এটিএন বাংলার ধারাবাহিক নাটক গোয়েন্দা কাহিনীতেও সাংবাদিকের অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন।নৃপেণ বিশ্বাস সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক হিসেবে তৃতীয় বাংলাদেশ ফিল্ম মুভমেন্ট পদক, গ্রন্থনা ও পরিকল্পনায় বিশেষ অবদানের জন্য খন্দকার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক পদক, মানবসেবা পুরস্কার, নাট্যনির্দেশক ও অনুষ্ঠান নির্মাতা হিসেবে পদকসহ অনেকগুলো পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছিলেন।