স্ত্রী-সন্তান হত্যায় অভিযুক্ত শাহেদ নাকফুলটিও বিক্রি করেছিল

Spread the love

স্টাফ রিপোর্টার :

শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা। ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের বাড়ির শিরিন বেগমকে শাহেদ বললেন ‘মনিরা ফাঁসি নিয়েছে’। শিরিন বেগমসহ প্রতিবেশীরা ঘরে ঢুকে দেখলেন মনিরা বেগম ঘরের আড়ায় ফাঁসিতে ঝুলছে। পাশেই বিছানায় পড়ে আছে মনিরা বেগমের দুই শিশু সন্তান মুশফিক (৭) ও মাশরাফির (২) মরদেহ।  

এরপর থেকে বাবা শাহেদ উধাও। খবর পেয়ে দেলদুয়ার থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে মরদেহ তিনটি উদ্ধার করে।  

ঘটনাটি ঘটে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের চকতৈল গ্রামে। প্রথমে স্থানীয়রা ধারণা করেছিলেন দুই সন্তানকে হত্যা করে মা আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু স্বামী উধাও হওয়ার পর সন্দেহের তীর যায় শাহেদের দিকে। পুলিশও শাহেদকে সন্দেহের রেখেই তদন্ত করছে। জানাজা ও দাফন-কাফনেও শাহেদ না আশায় সন্দেহ আরও গভীর হচ্ছে।

রোববার শাহেদকে প্রধান, শাহেদের বাবা ফজলু মিয়া, চাচাতো ভাই লিটুসহ তিনজনকে আসামি করে নিহত মনিরার মা আবেদা বেগম বাদী হয়ে দেলদুয়ার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এতে অজ্ঞাত আরও তিন-চারজনকে আসামি করা হয়েছে।

মামলার বাদী আবেদা বেগম ও মনিরার ভাই আলামিন জানান, প্রায় ১১ বছর আগে পাশের বাড়ির শাহেদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে মনিরার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই শাহেদ যৌতুকের দাবিতে নানাভাবে মনিরাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। একাধিকবার নগদ অর্থ দিয়েও নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি মনিরার পরিবার।

মাদকাসক্ত শাহেদ প্রায়ই টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। বড় ছেলে মুসফিকের জন্মের সময়ও সিজারের টাকা দিতে হয় মনিরার বাবা-মাকে। মনিরার ব্যবহৃত স্বর্ণের গহনা বিক্রি শেষ হলে মনিরার নাকফুলটিও বিক্রি করে দেয় দুই সন্তানসহ মাকে হত্যায় অভিযুক্ত মাদকাসক্ত শাহেদ।  

মনিরা বাবার বাড়ি ফিরে যাওয়ায় হত্যার হুমকি দিয়ে স্ত্রীকে আবার নিজের বাড়ি নিয়ে আসে শাহেদ। এরপর মনিরার ওয়ারিশের জমির অংশ বিক্রি করে শাহেদ টাকা নিয়ে নেন। অবশেষে থাকার ঘরটিও বিক্রি করে শাহেদ। বিভিন্ন সময় শাহেদের আর্থিক দাবি মনিরার পরিবার পূরণ করতে না পারায় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে প্রায়ই ঝগড়া হতো। যার ধারাবাহিকতায় মনিরা ও তার দুই সন্তানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে পালিয়েছে শাহেদ। এমনটাই ধারণা করছেন নিহত মনিরার স্বজনরা।

শাহেদ পলাতক থাকায় সোমবার বিকেল পর্যন্ত পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এ দিকে শাহেদ গ্রেপ্তার না হওয়ায় নিহত মনিরার একমাত্র ভাই আলামিন ও তার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।  

আলামিনের দাবি, এর আগে আলামিনকেও হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন শাহেদ। শাহেদকে দ্রুত গ্রেপ্তার না করা হলে তাদের পরিবারের ক্ষতি করতে পারে শাহেদ।  

এ দিকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধারের দিন শনিবার দুপুরে অজ্ঞাত দুজন যুবককে মনিরার বাড়িতে ঢুকতে দেখেছেন মনিরার স্বজনসহ প্রতিবেশীরা। কে এই দুই যুবক?  স্বজনদের দাবি, একা তিনজনকে হত্যা করতে পারেনি শাহেদ। অজ্ঞাত ওই দুই যুবক ভাড়াটে মাদকাসক্ত কিলার কিনা শাহেদকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন মনিরার স্বজনরা।

মনিরার স্বামী শাহেদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় শাহেদ ও তার বাবা ফজলু মিয়াসহ সবাই পলাতক। বাড়িতে রয়েছেন শাহেদের খালা সেলিনা বেগম। তিনি জানান, তিনজনের মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি এ বাড়িতে এসেছি। বাড়িতে আসার পর আমি শাহেদ বা শাহেদের বাবাকে পাইনি। তারা উধাও। মনিরার আত্মহত্যার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মনিরাকে শাহেদ হত্যা করলেও একা করতে পারেনি। অবশ্যই তার সঙ্গে কেউ ছিল। তাদের খুঁজে বের করলে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।

স্থানীয়রা জানান, শাহেদ দীর্ঘদিন ধরে মাদকাসক্ত। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস একে একে বিক্রি করেছেন। সর্বশেষ গত সপ্তাহে তাঁর টিনের ঘরটিও বিক্রি করে দেন। এ নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হতো। এর জেরে স্ত্রী মনিরা বেগম ও দুই সন্তানকে শাহেদ হত্যা করে পালিয়েছেন বলে ধারণা করছেন মনিরার পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীরা। এছাড়া হত্যা করার আগে স্ত্রী-সন্তানকে কোনো ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে হত্যা করতে পারেন বলেও স্বজনরা মনে করছেন।

এ ছাড়া মনিরার ঝুলন্ত মরদেহ মাটিতে লেগে থাকা ও ঘরে সিঁধ কেটে শাহেদ উধাও হওয়ায় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। শাহেদের বিরুদ্ধে দেলদুয়ার থানায় মাদকের মামলাও রয়েছে। এলাকায় শাহেদের বিরুদ্ধে একাধিক চুরির অভিযোগও রয়েছে।

দেলদুয়ার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসির উদ্দিন মৃধা জানান, শাহেদকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। শাহেদকে গ্রেপ্তার করা হলে দ্রুত এ হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করা যাবে বলে তিনি আশা করছেন। শাহেদের বিরুদ্ধে মাদকের মামলার কথাও স্বীকার করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। চুরির মামলা কেউ না করলেও এলাকায় শাহেদের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগের কথাও জানান তিনি।

যুগধারা ডট টিভি/অন্তু