যুগধারা ডেস্ক :
অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা-দীক্ষাসহ নাগরিক নানা সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত হাওরবেষ্টিত সীমান্ত এলাকা সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলা। এখানে প্রায় তিন লাখ মানুষের বাস। যাদের বেশির ভাগই শ্রমজীবী, আর তাদের জীবিকার বড় উৎস যাদুকাটা নদী। শুধু তাদের জীবিকাই নয়, এই নদী ঘিরে রয়েছে এই এলাকার উন্নয়নের অপার সম্ভাবনাও।
ভারতের মেঘালয় রাজ্য হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে আন্তঃসীমান্ত নদী যাদুকাটা। এই নদীর স্রোতে সীমান্তের ওপার থেকে বাংলাদেশে ভেসে আসা কয়লা ও বালু উত্তোলন করে কয়েক যুগ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে তাহিরপুর, এর পার্শ্ববর্তী বিশ্বম্ভরপুর ও জামালগঞ্জ – এই তিন উপজেলার প্রায় ২০ হাজার মানুষ। তাহিরপুরের বাদাঘাট ও বড়দল উত্তর – এই দুই ইউনিয়নের ২৩ কিলোমিটার জুড়ে বয়ে চলেছে যাদুকাটা।
তাহিরপুর উপজেলায় কোনো কল-কারখানা নেই। তাই প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা উপজেলাটির মানুষ আয়ের জন্য কায়িক পরিশ্রমকেই বেছে নিয়েছেন, বা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার কয়েক হাজার কয়লা ও বালু ব্যবসায়ী, নৌযান মালিক ও শ্রমিকের জীবিকার উৎস যাদুকাটা নদী। এখানে উত্তোলিত কয়লা ও বালু রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, বাজিতপুর, খুলনা, বরিশাল, ভোলা, ফেনী, সিরাজগঞ্জসহ দেশের নানা প্রান্তে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে স্টিলবডির (স্টিল দিয়ে তৈরি) বড় বাল্কহেড এবং ছোট ছোট নৌযান এসব কয়লা ও বালু পরিবহন করে থাকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই নদী থেকে সরকার প্রতিবছর অর্ধশত কোটি টাকা রাজস্ব পেয়ে থাকে।
যাদুকাটা যেমনি প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ তেমনি অপরূপ দেখতে। এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের ভাষায় – ‘রূপের নদী যাদুকাটা’।
প্রতিদিন ভোরবেলা এ নদীতে কয়লা ও বালু আহরণের জন্য সারি বেঁধে শত শত বারকী নৌকা যখন প্রবেশ করে তখন এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা হয়। অন্যদিকে নদীটির পানি এতই স্বচ্ছ যে এর তলদেশের নুড়ি-বালু পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়।
যাদুকাটার কূলঘেঁষে রয়েছে নয়নাভিরাম বারেক টিলা। এখানে প্রতিদিন ভিড় করেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকরা। সবুজ-শ্যামলে আকীর্ণ টিলাটিতে রয়েছে আদিবাসী পল্লী। তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আকৃষ্ট করে থাকে পর্যটকদের।
বারেক টিলার ওপর থেকে তাহিরপুর উপজেলার প্রায় পুরোটাই দৃষ্টিগোচর হয়। এছাড়া টিলার ওপর দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে তাকালে চোখে পড়ে স্তরে স্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড়। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য!
বরিশাল থেকে এখানে ঘুরতে আসা রাশেদ হাসান বলেন, নদীটির সৌন্দর্যের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি। অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল এখানে আসার। সত্যিই যাদুকাটা নদী রূপে-গুণে অনন্য।
কিশোরগঞ্জ থেকে আসা পর্যটক গোলাম মোর্শেদ এ্যানি বলেন, তাহিরপুর উপজেলা এমনিতেই অনেক সুন্দর । কিন্তু এই নদী তাহিরপুরের সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চেয়েও বেশি সুন্দর।
শাহজাদপুরের উল্যাপাড়া থেকে আসা পর্যটক শাহ্ নেওয়াজ বলেন, সত্যিই নদীটি আসাধারণ। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াতে আসার জন্য উপযুক্ত স্থান। আসলেই ‘রূপের নদী যাদুকাটা’।
বাদাঘাট ইউপি চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন বলেন, যাদুকাটার সৌন্দর্য দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজারো পর্যটক আসেন। অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলে এখান থেকে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হবে। সেই সঙ্গে বদলে যাবে এই অবহেলিত, অনুন্নত সীমান্ত এলাকার মানুষজনের জীবন।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের প্রজেক্ট ডিরেক্টর শিপ্রা দে জানান, সুনামগঞ্জের পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করতে জলবায়ু পরিবর্তন কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থায়নে কয়েকটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তাহিরপুর উপজেলার শহীদ সিরাজ লেকের (নীলাদ্রী লেক) পার্শ্ববর্তী হিলভিউতে একটি অত্যাধুনিক রেস্তোরাঁ ও একটি কটেজ নির্মাণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। পর্যায়ক্রমে জয়নাল আবেদিনের শিমুলবাগান, বারেক টিলা ও টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, যাদুকাটা নদীসহ তাহিরপুর উপজেলার পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করতে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যেই এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ শুরু হবে।