যুগধারা ডেস্ক :
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনার ৯ বছর পার হলেও আজও রায় কার্যকরের আশায় স্বজনরা।
২০১৪ সালের নৃশংস এ ঘটনা নাড়া দেয় গোটা দেশবাসীকে।
একের পর এক উদ্ধার হতে থাকা মরদেহ দেখে স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরের আকাশ বাতাস।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল অপহরণের পর হত্যা করা হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীমকে।
অপহরণের তিন দিনের মাথায় ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠে একের পর এক সাতটি মরদেহ। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের পর নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এ ঘটনায় নিহত অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল ও নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় দুটি মামলা করেন।
নানা নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ভারত থেকে আটক করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এবং আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া আসামিদের জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে হত্যার লোমহর্ষক বিবরণ।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এই হত্যা মামলার রায়ের পর ২০১৮ সালের ২২ অগাস্ট ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে উচ্চ আদালত। অন্য আসামিদেরও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়।
বর্তমানে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। এই মামলার রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান নিহতদের পরিবারসহ নারায়ণগঞ্জবাসী।
কী ঘটেছিল সেদিন?
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় দায়ের করা চাঁদাবাজির একটি মামলায় নারায়ণগঞ্জ জেলা জজ আদালতে জামিন নিতে আসেন কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম। আদালতপাড়ায় তার আগমনের খবরে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন র্যাবের তৎকালীন মেজর (অব.) আরিফ হোসেন।
সে দিন (২৭ এপ্রিল) সকাল থেকেই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড় করান অপহরকারীদের। সাদা পোশাকে র্যাবের একটি টিম অবস্থান নেয় আদালত এলাকায়। জামিন নিয়ে আদালত থেকে বের হওয়ার পর পরই মেজর আরিফের কাছে খবর পৌঁছে দেয় আদালতে অবস্তানকারী টিম।
সে দিন নিজস্ব গাড়ির বদলে বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপনের সাদা এক্স করোলা গাড়িতে করে আদালতে আসেন নজরুল। এ সময় তার সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন স্বপন, সিরাজুল ইসলাম লিটন, তাজুল ইসলাম ও গাড়ির ড্রাইভার জাহাঙ্গীর। আদালতপাড়া থেকে বের হয়ে লিংক রোডের ওসমানী স্টেডিয়ামের সামনে পৌঁছানোর পরেই সাদা পোশাকে অস্ত্র দেখিয়ে অপহরণ করা হয় নজরুল ও তার সহযোগীদের। নজরুলের পেছনের গাড়িতেই আসছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। তার গাড়িটিও আটকায় অপহরণকারীরা। তুলে নেয় চন্দন ও জাহাঙ্গীরকে।
গাড়িতে ওঠানোর পর একের পর এক ইনজেকশন পুশ করা হয় তাদের শরীরে। ইনজেকশন পুশ করে অচেতন অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা তাদের গাড়িতেই রাখা হয়। পরবর্তীতে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় নরসিংদী।
রাত ১০টার দিকে ঘটনার নেপথ্যে থাকা খলনায়ক নূর হোসেনকে ফোন দেন আরিফ। কাঁচপুর ব্রীজের পশ্চিম পাড়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বালু-পাথরের ব্যাবসাস্থল জনশূন্য করতে বলেন নূর হোসেনকে। পুরো এলাকা খালি হওয়ার পর গাড়ি নিয়ে সেখানে পৌঁছায় র্যাব সদস্যরা। সেখানে পৌঁছে গাড়ির ভেতরেই অচেতন অবস্থায় প্রত্যেকের মাথা পলিথিন দিয়ে ঢেকে একে একে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় সাতজনকে।
হত্যার পর সাতজনের নিথর দেহ গাড়ি থেকে নামিয়ে র্যাবের নির্দিষ্ট নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হয় কাঁচপুর ব্রিজের নিচে। মরদেহগুলো নৌকায় উঠিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে যাওয়ার পথেই গুমের উপকরণ নৌকায় তোলা হয়। নৌকার মধ্যেই সাতজনের শরীরে ২৪টি করে ইটবোঝাই সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বাঁধা হয়। এরপর হাত পেছনে নিয়ে রশি দিয়ে বাঁধা হয়। তারপর পলিথিনে মোড়ানো মরদেহগুলো নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
পরে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের শান্তিনগর এলাকা সংলগ্ন নদীতে কয়েকটি মরদেহ ভাসতে দেখে পুলিশে খবর দেয় স্থানীয়রা।
আলোচিত এই সাত খুনের মামলায় তৎকালীন কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত। এছাড়া বাকি ৯ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন ২৩ জন, পলাতক রয়েছেন ১২ জন।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- নাসিকের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মুহাম্মদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (অব.) মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, র্যাব সদস্য এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সিপাহী সাদুজ্জামান নূর, নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী, আবুল বাশার, নূর হোসেনের সহযোগী ভারতে গ্রেপ্তার সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান, জামাল উদ্দিন, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আলামিন শরীফ, সৈনিক তাজুল ইসলাম ও সার্জেন্ট এনামুল কবির।
সাজাপ্রাপ্তরা হলেন- ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন (১০ বছর), এএসআই বজলুর রহমান (৭ বছর), হাবিলদার নাসির উদ্দিন (৭ বছর), এএসআই আবুল কালাম আজাদ (১০ বছর), সিপাহী নুরুজ্জামান (১০ বছর), বাবুল হাসান (১০ বছর), র্যাবের সদস্য কর্পোরাল মোখলছুর রহমান (১০ বছর), এএসআই কামাল হোসেন (১০ বছর) ও কনস্টেবল হাবিবুর রহমান (১৭ বছর)।
মামলার বাদী নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি জানান, রায় হলেও এখনো কার্যকর হয়নি। কিসের জন্য অপেক্ষা, কার ইশারায় রায় কার্যকর থমকে আছে? আমরা দ্রুত রায় কার্যকর চাই।
বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান জানান, আমরা দ্রুত রায় কার্যকর দাবি করছি। রায়ের পর এভাবে বছরের পর বছর ধরে আসামিরা কারাগারে, অথচ তাদের ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে না।
যুগধারা ডট টিভি/অন্তু