টাঙ্গাইলের সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে কিছু কথা

Spread the love

মোঃ মিয়াচান (মাস্টার) ঃ প্রায় একশত বায়ান্ন বছর আগে ১৮৭০ সালে টাঙ্গাইলের সন্তোষ ছয়আনীর মহিলা জমিদার বিদ্যোৎসাহী শ্রীমতি জাহ্নবী চৌধুরাণী অত্র এলাকার জনগণের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে জমিদারীর অর্থে নিজ বসতবাড়ীর আঙ্গিনায় প্রায় ৪.৫০ একর জায়গায় তাঁরই নামে প্রতিষ্ঠা করেন সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়। এটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার দ্বিতীয় এবং টাঙ্গাইল জেলার সর্বপ্রাচীন উচ্চ বিদ্যালয়। তিনি পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরামর্শ ও পরিকল্পনা মোতাবেক ৩শ ফুট দীর্ঘ চুন সুরকীর ২৪ ইঞ্চি দেয়ালে ২০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট সুদৃঢ় ও সুদৃশ্য মনোরম পাকা অট্টালিকা নির্মাণ করেন যা আজও ঐতিহ্য ও বিস্ময়ের নিদর্শণ। সময় নিরূপনের সুবিধার্থে বিদ্যালয়ের সম্মুখস্থ সূর্য ঘড়ি (Sun Dial), বিশাল দীঘি এবং এর পারিপার্শিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বহু পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের স্বাচ্ছন্দের প্রতি লক্ষ্য রেখে জালানা বিহীন এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বরাবর সমান্তরাল ভাবে স্থাপিত ১০১ টি বিশালাকৃতি দরজা বিশিষ্ট প্রসাদোপম ইমারতটি সেকালের মত আজও কাছের ও দূরের শিক্ষিত জন সাধারণের দর্শণীয় বিদ্যাপীঠ।

শ্রীমতি জাহ্নবী চৌধুরাণী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির স্থায়ীত্ব রক্ষাকল্পে পরবর্তী সময়ে তাঁরই পুত্রবধু জমিদার শ্রীমতি দীনমনি চৌধুরাণী আজ থেকে শত বছর পূর্বে অবিভক্ত ভারতবর্ষের তৎকালীন মোমেনশাহী জেলার ম্যাজিস্ট্রেট বাবু রমেশ চন্দ্র দত্তকে চেয়ারম্যান করে “বৈকুণ্ঠনাথ দীনমনি ট্রাষ্টি ফান্ড” নামে একটি ফান্ড গঠন করে উক্ত ফান্ডে সর্বমোট তিন লক্ষ তেষট্টি হাজার টাকা সংগ্রহ করেন। এই টাকা কলকাতার ইস্প্যারিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া শাখায় জমা হয়েছিল এবং উক্ত টাকার লভ্যাংশ ১৯৫৫ ইং সন পর্যন্ত বিদ্যালয় ফান্ডে জমা হয়েছিল। এভাবেই বৃটিশ আমলে সর্বশেষ সময় পর্যন্ত কোন রকম সরকারী সহযোগীতা ছাড়াই সন্তোষ জাহ্নবী স্কুলের অর্থের প্রয়োজন মিটানো হতো। এরপর অজ্ঞাত কারণে উক্ত অনুদান বন্ধ হয়ে যায়।

এই বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, আসবাবপত্র ও বিজ্ঞান শিক্ষার সহায়ক দ্রব্যাদি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জমিদারগন বিদ্যালয়ের জন্য সংগ্রহ করেন। এই বিদ্যালয়ের পাঠাগারে জ্ঞানবিজ্ঞানের বহু পুস্তকাদি রয়েছে যার মধ্যে ৩৬ খন্ডের বিশ্বকোষ ÒEncyclopaedia BritenicaÓ উল্লেখযোগ্য। পাক- ভারত উপমহাদেশে অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি রয়েছেন, যাদের নাম এখানে উল্লেখ করা গেল না, যারা এই বিদ্যাপীঠের ছাত্র হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুনাম উপমহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন।

পন্ডিত ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সাহিত্য স¤্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, রমেশ চন্দ্র দত্ত, মীর মশারফ হোসেন, কবি কায়কোবাদ, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, নলীনী মোহন সেনগুপ্ত প্রমুখ গুনিজন এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সুবিখ্যাত ও বহুল পরিচিত গ্রন্থ ” ঠাকুমার ঝুলি” লেখক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার এই বিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলেন। সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়ের এই বহুল পরিচিতির মূলে রয়েছে জন্মলগ্ন থেকেই শিক্ষাঙ্গনে এর অবিস্মরণীয় গৌরবোজ্জল সাফল্য এবং এর ফলশ্রুতিতেই প্রতিষ্ঠার পর-পরই বিদ্যালয়টি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্থায়ীভাবে অনুমোদন লাভ করে। সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়টি এর জন্মলগ্ন থেকেই ঐতিহ্যবাহী। বিদ্যোৎসাহী জাহ্নবী চৌধুরাণী বিশেষ বিশেষ পন্ডিত ব্যক্তিদের তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার দায়িত্ব প্রদান করতেন। প্রথম প্রধান শিক্ষক বাবু তারকবন্ধু চক্রবর্তী ১৮৭৪ খ্রিঃ এ ময়মনসিংহ জেলার ডেপুটি ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হওয়ার শ্রদ্ধেয় বাবু ললিত মোহন মজুমদার প্রধান শিক্ষক এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তাকেই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে গণ্য করা হয় তিনি ১৯০০ খ্রিঃ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৯৬ সালে তারই ছাত্র মহিম চন্দ্র ঘোষ তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রবেশিকা (এন্ট্রাস) পরীক্ষায় বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম ও ব্রহ্মদেশ এই ৫টি প্রদেশের মধ্যে প্রথম বিভাগে প্রথম হবার গৌরব অর্জন করেছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি বোম্বাই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করেন।

এরপর ১৯১৬ খ্রিঃ বাবু ললিত কুমার নিয়োগ এম.এ প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর সময়ে ১৮৯৬ সনের পুনঃরাবৃত্তি ঘটে। ১৯২৬ খ্রিঃ এ দেবেন্দ নাথ ঘোষ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেই ৫টি প্রদেশ এলাকার ম্যাট্টিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন। তিনি পশ্চিম বাংলা শিক্ষা বিভাগে ডাইরেক্টর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং কলিকাতায় তাঁরই নামে দেবেন্দ কলোনী এখনও তাঁর স্মৃতি বহন করেছে। ১৯৪৮ খ্রিঃ এ তার অবসর গ্রহণের পর ১৯৫৭ খ্রিঃ এ আবার একজন সুযোগ্য প্রধান শিক্ষক যিনি এই বিদ্যালয়েরই একজন প্রাক্তন ছাত্র মোঃ মাঈন উদ্দিন বি,এ বি, টি বিদ্যালয়ের কর্ণধার হন। একজন দক্ষ প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর কৃতিত্বের নিদর্শন হল তাঁর সময়ের ঢাকা বোর্ডের অধীনে ১৯৬৫ সালে নিতাই দাস পাল এবং ১৯৬৯ সালে আশীষ কুমার পাল এস, এস, সি পরীক্ষায় মানবিক শাখায় প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে বিদ্যালয়ের গৌরব অক্ষুন্ন রাখেন। নিতাই দাস পাল বর্তমানে কলকাতায় এম, বি, বি, এস ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও আশীষ কুমার পাল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়ের সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমান সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়, টাঙ্গাইল সদর এর প্রধান শিক্ষক মোঃ মিয়াচান দায়িত্ব পালন করছেন।