আখতার হোসেন খান:
“পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়/রূপ কাঠেরই নৌকা খানি নাই ডোবার ভয়।” লালন সাঁইজির এই গানেই নিহিত আছে তার ইসলামী চেতনা। তাছাড়া তিনি শুধু গানই করেননি ‘নবীর নৌকাতে আয়’ বলে ইসলামের দাওয়াতও দিয়েছেন, ইসলামে আহবান জানিয়েছেন।
পৃথিবীর মানুষগুলো নিজ নিজ ধর্ম বিশ^াসে বিভক্ত হয়ে আছে। ইসলাম ধর্ম, সনাতন ধর্ম, খৃস্ট ধর্ম, জৈন ধর্ম নিয়ে যে বিভেদ, লালন সেই বিভেদ মুক্ত একটি মানব জাতি, একটি মানব সমাজের ধারণা দিয়েছেন। তিনি ধর্ম বিদ্বেষী ছিলেন না। “আমি দিল কা’বাতে নামাজ পড়বো/আল্লাহু আকবর/ আমাকে মসজিদে, মন্দিরে গির্জাতে যেতে বলো না/আমি দিল কা’বাতে নামাজ পড়বো…।” এই গানেও লালন নামাজের কথাই বলেছেন। যারা পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক করবেন তাদের জন্যে তিনি গেয়েছেন- “বহু তর্কে দিন বয়ে যায় বিশ^াসের ধন…. তর্কের দোকান সে করে আর…।” তিনি তর্কে জড়াতে চাননি। তিনি তার গানের মধ্য দিয়ে মানব গোষ্ঠির একটি জাতি গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তাই তো লিখলেন- “মানুষ ভুজলে সোনার মানুষ হবি…।”
সারা বিশে^র যে হানাহানি; তার বড় একটি কারণ হচ্ছে-‘ধমর্’। খ্রিস্টান ধর্মগুরু পোপদের স্বার্থের কারণে হয়েছিলো ক্রুসেট। ১০৯৫ থেকে ১২৯১ সাল পর্যন্ত ১৯৬ বছর হয়ে ছিলো-ক্রসেট বা ধর্মযুদ্ধ। । অগ্নি উপাসক ও পুতুল পূজারীদের বিরুদ্ধে ইসলামী মতাদর্শের লড়াই, ইসলাম প্রতিষ্ঠার লড়াই বদর, ওহুদ, খন্দকের যুদ্ধ হয়েছিলো ধর্মীয় কারণেই। আফগানিস্তান ও ইরাকের পতন হয়েছে ধর্মীয় কারণে। ফিলিস্তিন এবং ইসরাইলী যুদ্ধ চলছে মুসলিম- খ্রিস্টান জাত নিয়ে। এই জাত রক্ষার মানসিকতার কারণে দুনিয়াতে অধিকাংশ সংঘাত সংঘটিত হয়েছে। সম্রাট আকবর হিন্দু এবং মুসলিম স্ত্রীদের নিয়ে সংসার ধর্ম পালন এবং ধর্মীয় সংঘাত থেকে শাসন ব্যবস্থাকে মুক্ত রাখতে সকল ধর্মের সার বস্তু নিয়ে ১৫৮১ সালে একটি নতুন ধর্ম ‘দ্বীন-ই ইলাহী’ প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন, উদ্দেশ্য একটাই ধর্ম নিরপেক্ষতা।
লালন কিন্তু তাও করেননি। তিনি ইসলামকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। যদিও তিনি কোন্ ধর্মের তা বলেননি। তিনি বললেন, “সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীর তবে কি হয় বিধান/ পৈতাতে ব্রাহ্মণ প্রমাণ বামনী চিনি কিসে রে…।” কথা সাহিত্যিক শরৎ চন্দ্র তার শ্রীকান্ত উপন্যাসে একই কথা বললেন- “মরার আবার জাত কি?” লালন মানুষকে ধর্ম এবং বর্ণ দিয়ে বিচার করেননি। তিনি বললেন, মানুষের মধ্যে কোনো ভাগ নেই, সবার আকৃতি-প্রকৃতি যেমন এক, তেমনি শরীরে প্রবাহমান রক্তও এক। ভাগ করা হলে দুই ভাগে ভাগ করা যায়- নারী ও পুরুষ। মানুষ এক জাতি। চন্ডিদাস বললেন, “সবার ওপওে মানুষ সত্য তাহার ওপওে নাই।” কবি নজরুল বললেন, “গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয়/ নয় কিছু মহিয়ান।” আর লালন বললেন, “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”
মানবতাবাদই লালন সাঁইয়ের ধর্ম-কর্ম-জ্ঞান। তিনি সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ আল্লাহ তা’লায় বিশ^াসী ছিলেন। তাই তো তিনি গাইলেন, “আল্লাহ্ বলো মন রে পাখি/একবার মওলা বলো মন রে পাখি…।” মহাপুরুষ মহানবী (স.) কেও যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন তিনি এবং আল্লাহ্, রাসুল (স.) এবং ইসলামে বিশ^াস এনেছেন। এ কারণে তিনি গাইলেন, “ওপারের কান্ডারী নবীজি আমার/ ভজন সাধন বৃথা নবীজি না চিনিলে/ নবী আওয়ালে আখেরে বাতনও জাহেরে/কখন কোন রূপ ধারণ করে/ কোন্ খানে…।”
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) একজন মডেল মানুষ হিসেবে দুনিয়াতে আর্ভিভূত হয়েছেন। আমাদের সমাজে অধিকাংশ এতিমকে নানাবিধ কারণে অসৎ হতে দেখা যায়। এতিম হলেই অসৎ হতে হবে না। সৎ থেকেও যে, বেঁচে থাকা যায়; মানুষ হওয়া যায় তা মহানবী (স.) করে দেখিয়েছেন।
কি দেখাননি তিনি? অন্যের বাড়িতে কিভাবে কাজ করতে হয়, অন্যের ব্যবসা কিভাবে পরিচালনা করতে হয়, হত দরিদ্রদের জীবন যাপনে কিভাবে ধৈর্য ধারণ করতে হয়, একাধিক বিয়ে করে কিভাবে সব স্ত্রীকে খুশি রেখে সংসারধর্ম পালন করতে হয়, কিভাবে ধ্যান-সাধনা করতে হয়, কিভাবে যুদ্ধ পরিচালনা ও নেতৃত্ব দিতে হয়, কিভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয় (?) সব প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজে করে দেখিয়ে গেছেন।
লালন সাঁই সেই নবীজিকে স্রষ্টার আদর্শ রূপ হিসেবে দেখেছেন- “যেই মুর্শিদ সেই রাসুল/ খোদাও সে হয়/ এ কথা লালন নয়/ কোরানে কয়…।” আল্লাহ্ স্বয়ং কোরানে ঘোষণা দিলেন, “আমি তাকে সৃষ্টি না করলে, দুনিয়াই সৃষ্টি করতাম না।” সুতরাং নবীজির গুরুত্ব অপরিসীম। নবীকে ছাড়া আল্লাহকে পাওয়া অসম্ভব। তাই লালন গাইলেন- “মন কি ইহাই ভাবো/ আল্লাহ্ পাবো/ নবী না চিনে?/কারে বলিস নবী/ দিশে পালি নে…।” অনেক গানে একই কথা বলেছেন কবি, “রাসুলকে না চিনিলে রে/ খোদার দেখা পাবা না/ রাসুলকে না চিনিলে/ খোদা মিলে না… ?” তাহলে লালন সাঁইজিকে ইসলাম বিরোধী এবং ইসলাম বিদ্বেষী বলা যায় না।
অপর গানে আছে-“মানুষ ক্যামনে যাবি পাড়ে/নবী না হলে… ?” নবীকে ছাড়া পুলসুরাত পার হওয়ার সুযোগ নেই। আরো একটি গানে আছে- “নবীজি আমার পারেরও কান্ডার…।” তাহলে দেখা যাচ্ছে সাঁইজি ইহকাল এবং পরকালেও বিশ^াসী ছিলেন। মানুষ যদি তার আদর্শে নিজের জীবন গড়তে চায় তাহলে হয়তো সে মানুষ,সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি করতে পাবে না। কেউ যদি তার আদর্শমেনে নেয় এবং অন্যায়ও করে সে দায় তার নিজের।
লালন সাঁই ইসলাম ধর্মের প্রতি মানুষকে যেমন আহবান করেছেন, তেমনি নিজের মাঝে সৃষ্টি রহস্য সন্ধান করতে বলেছেন। এজন্য বলা হয়ে থাকে- ‘আগে নিজেকে চেনো’। “আপনারে চিনতে পারলে রে/ যাবে অচেনারে চেনা/ যার আপন খবর আপনার হয়না…।” একই কথা সক্রেটিস বলেছেন- “কহড়ি ঃযু ংবষভ.” (নিজেকে জানো।) সাঁইজি বললেন- “আদি মক্কা এই মানব দেহে/ দেখ না রে মন ভেবে/দেশ দেশান্তর দৌড়ে কেনো/ মরতেছো হাপিয়ে…?” তিনি আল্লাহ্তা’লাকে নিজের ভেতরে খুঁজতে বললেন- “ডুবে দেখ না রে প্রেম নদীতে/ মীম রূপে সাঁই খেলে…?” একই রকম বাণী আরেকটি গানে- “বাড়ির পাশে আরশি নগর/সেথা এক পরশী বসত করে/আমি একদিনও না দেখিলাম তারে/ সে আর লালন একখানে রয়/তবু লক্ষ যোজন ফাঁকরে…।”
আল্লাহ্ এবং রাসুল (স.) একই সমান্তরালে- এমন বার্তা পাওয়া যায় লালন দর্শনে। সূরা আল নিসা ৫১/৫২ নং আয়াতে উল্লেখ আছে- “তোমরা আল্লাহ ্এবং রাসুল (স.) আলাদা করে দেখো না।” যে কারণে আল্লাহ্ স্বয়ং রাসুলকে (স.) দোস্ত বলেছেন। লালন গাইলেন- “রাসুলকে চিনলে পরে/ খোদা চেনা যায়।/ও রূপ ভাবায়ে দেশ বেড়ায়ে/গেলেন আমার দয়াময়…।”
সর্বোপরি লালন সাঁই বহু গানে আল্লাহ্ এবং রাসুলকে (স.) স্বীকার করেছেন এবং ইসলামের দাওয়াতও দিয়েছেন। নবীর তরিকা মতে জীবন যাপনের আহবান জানিয়েছেন। তাঁর তরিকা ছাড়া স্রষ্টার নাগাল পাওয়া যাবে না; এমন বার্তা রয়েছে লালন গানে।
মানব সমাজে চার তরিকা শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত মারেফত পালন পদ্ধতিতে যে, বিতর্ক রয়েছে তা কিন্তু রাসুলের জীবনে ঘটে নাই। তাঁর জীবন ব্যবস্থায় চার তরিকার সমন্বয় ঘটেছে। নবীর তরিকা মতে চললে আল্লাহ্র করুণা ও দর্শন মিলবে- এমন বার্তাই লালন গানের প্রধান উপজীব্য।
আজ থেকে ১৪৯ বছর আগে লালনের জন্ম হয়ে ছিলো। ১৩৩ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৯০ সালের ৩১ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়েছে (হিতকরী পত্রিকা)। লালন ১১৬ বছর কাল জীবিত থেকে মানব ধর্ম পালন করে গেছেন।
(লেখক : অধ্যাপক ও সাংবাদিক)